বছর পেরোলেও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার বিচারে অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার স্মরণসভার বক্তারা।
Published : 31 Oct 2016, 10:20 PM
দীপন সত্য ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এখনও ‘এক আহ্বান ও সংকেত’ হিসেবে কাজ করছেন বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সোমবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে দীপন স্মৃতি সংসদের আয়োজনে এই স্মরণ সভায় তিনি বলেন, “দীপন চলে গেল, সময় পার হচ্ছে তার অপরাধীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। আমরা একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করছি। বিচারের বাণী শুধু নিভৃতে কাঁদে না, বিচারের বাণী শুকিয়ে গেছে। আমাদের রাষ্ট্রে কোনো জবাবদিহি নেই। আমাদের রাষ্ট্র জবাবদিহির দায় মানে না। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহি করেন না।
“অভিজিত হত্যার বিচার হচ্ছে না, সাগর-রুনী হত্যার বিচার হচ্ছে না। এখানে বিচার হচ্ছে না। এর কারণ পরিষ্কার- শাসক বদল হয়েছে, কিন্তু শাসকের চরিত্র বদল হয়নি।”
গত বছর ৩১ অক্টোবর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের অফিসে খুন হন জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক দীপন, যিনি ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেছিলেন।
অভিজিতের পর ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর বাবুকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিকারে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা আমরা দেখছি না। কেউ যদি ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে তাহলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেবে এমন বিধান রয়েছে। কিন্তু গুপ্তহত্যার স্বীকৃতি রাষ্ট্র দেয় না। এ অধিবার কারও নেই।
তিনি বলেন, “আমরা সভ্য সমাজের মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই। দেশের পরিচালকদের কাছে এই দাবি। সেইসঙ্গে সকল মানুষের প্রতি আহ্বান, আমরা একে অপরের হাতে হাত রেখে চলি- এই মানসিকতা ধারণ করুন।”
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ক্ষমতাসীনরা ছকে বাধা কথাই বলছেন, তাদের নিয়মের বাইরে গিয়ে কথা বললেই চলছে জুলুম-জবরদস্তি। কথা বলতে গেলেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। মানুষ মনোবল হারাচ্ছে।”
রাজনীতিবিদ, শিল্পী-লেখক-সংস্কৃতিকর্মীরা নানা ধারায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে থাকলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সন্ত্রাসীর চাপাতির আঘাতে প্রাণ হারানো লেখক অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, “মামলাগুলোর অগ্রসরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ‘চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই’। কিন্তু আমি তাদের বলেছি, এটি আপ্তবাক্য।”
অভিজিৎ, দীপন, নীলয়, অনন্ত হত্যার রেশ ‘এখনও কাটেনি’ মন্তব্য করে তিনি প্রশ্ন করেন, “এসব ঘটনার পর সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?”
শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, “এ এক অস্বাভাবিক মুহূর্ত। ছাত্রের মৃত্যু দিবসে আমাকে স্মৃতিচারণ করতে হচ্ছে- এটা কল্পনা করিনি কখনও। এটা আমাদের জন্য খুব কঠিন এক ভার।
“লেখাপড়ার বাইরেও যে কোনো উদ্যোগে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে দীপনের মতো উদ্যমী কেউ ছিল না।”
‘দীপনের আলোতে প্রাণময়’ শিরোনামের এই স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন দীপন স্মৃতি সংসদের সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, “দীপন উচ্চতর জীবনলক্ষ্যের পথে এক অনন্য সৈনিক ছিলেন।”
নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে দীপনের মৃত্যু হয়নি। ধর্মনিরক্ষেতার যারা শত্রু তারা দীপনকে হত্যা করেছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজই পারে মৌলবাদী সমাজকে প্রতিহত করতে। সে কারণে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।”
সভায় অন্যদের মধ্যে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সহ-সভাপতি মেজবাহউদ্দীন আহমদ, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা, পুস্তক প্রকাশক সমিতির পরিচালক খান মাহবুব, দীপনের বন্ধু মমতাজ উদ্দীন ভুঁইয়া বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে ‘দীপন স্মারক গ্রন্থের’ মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। বইটি সম্পাদনা করেছেন গোলাম মোর্তোজা।
শাহবাগ চত্বর থেকে কাঁটাবন চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের নাম ‘দীপন রোড’ করার দাবি জানান বক্তারা। সেই সঙ্গে ৩১ অক্টোবরকে ‘প্রকাশক দিবস’ ঘোষণারও দাবি জানানো হয় স্মরণ মঞ্চ থেকে।
এই স্মরণ আয়োজনে আরও ছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনী, জাগৃতির বইমেলা, দীপনের ডিজাইন করা প্রচ্ছদ প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক পরিবেশনা এবং দীপনের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছে বক্স অফিস মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড।